ইচ্ছে অদম্য: শূণ্য থেকে প্রাসাদে…মার্ক জুকারবার্গ (Mark Zukerburg)
ছেলেটির
সফটওয়্যার ডেভেলপ করার নেশা সেই ছোট্টবেলা থেকেই। বয়স তখন ১০ কি ১২!
লেখাপড়ার চেয়ে প্রোগ্রামিং করার পেছনেই বেশি আগ্রহ, একারণে
প্রোগ্রামিংয়ের চেয়ে লেখাপড়ার পিছনেই বেশি সময় নষ্ট হতে থাকলো। চিকিৎসক
বাবাও ছেলের অদম্য ইচ্ছাটির কথা জেনেছিলেন সময়মতো। লেখাপড়া না করে
প্রোগ্রামিংয়ে সময় নষ্ট করছে জেনে তিনি এতটুকুও বিচলিত হননি। বরং তিনিই
ছেলের এ ইচ্ছার মশালে ড়্গণে ড়্গণে যেন ঘি ঢেলেছেন! নিজেই ছেলেকে
শিখিয়েছেন ‘আটারি প্রোগ্রামিং ভাষা’। ছেলে যখন কেবল প্রাইমারি শিড়্গার
দুয়ার পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা দিয়েছে, প্রোগ্রামিংয়ের নেশা তখন আরোও
বেড়েছে। ছেলের এ আকাংখাকে পূর্ণ করতে তখন সেসময়ের খ্যাতনামা সফটওয়্যার
ডেভেলপার ডেভিড নিউম্যান কে টিউটর হিসেবেও নিয়োগ দিয়েছেন বাবা। তারপর
থেকে প্রোগ্রামিংয়ে আরও দূর্দানত্ম গতিতে এগিয়েছে ছেলেটি। প্রোগ্রামিংয়ে
তার আগ্রহ তখন এতটাই যে মাধ্যমিক লেভেলে পড়ার সময়ই পার্শ্বের একটি
স্নাতক কলেজে (মার্সি কলেজ) কম্পিউটার বিষয়ে স্নাতকের বিষয় নিয়ে
লেখাপড়া করেছেন তিনি। জেনেছেন সফটওয়্যার ডেভেলপ করার বিভিন্ন কারিগরি
দিকগুলো, শিখেছেন উন্নত প্রোগ্রামিং ভাষা। সফটওয়্যার ডেভেলপ করার
ড়্গেত্রে ছেলেটির লড়্গ্য একটি নির্দিষ্ট গোলকে বন্দি ছিল। তিনি কেবল একটি
কম্পিউটারের সাথে অন্য কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ প্রক্রিয়া কিভাবে সহজ
করা যায় সেসব নিয়েই ভাবতেন, সফটওয়্যার তৈরি করতেন। বাবা বাসায় থেকেই
তার ডেন্টাল ক্লিনিক পরিচালনা করতেন। তাঁর বাবাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য
তিনি একবার মজার এক সফটওয়্যার ডেভেলপ করলেন। বাবার অফিসের এবং বাসার
কম্পিউটারগুলোর সাথে যোগাযোগ করার জন্য তিনি ‘জাকনেট’ নামে একটি সফটওয়্যার
তৈরি করলেন। এ সফটওয়্যারটির মূল কাজ ছিল কম্পিউটারে ‘পিং’ করার মাধ্যমে
তাৎড়্গণিক বিভিন্ন বার্তা পাঠানো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে বছরই একই রকম
প্রযুক্তি নিয়ে বাজারে এসেছিল ‘অ্যাওল ইনস্টান্ট মেসেজিং’ সেবা। এ
ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং সেবাটি নিয়ে সেসময়ে কোন প্রচারে জাননি তিনি। তার
ইচ্ছা ছিল এটিকে আরোও উন্নয়ন করে, নতুন ফিচার যুক্ত করে এমন একটি
নেটওয়ার্ক তৈরি করার যেখানে যেকেউ নিবন্ধণ করতে পারবে এবং এক অন্যের সাথে
সহজেই যোগাযোগ করতে পারবে।
মাধ্যমিক
লেভেলের শিড়্গা শেষ হওয়ার আগেই একটি নতুন প্রযুক্তির মিডিয়া পেস্নয়ার
তৈরি করেছিলেন তিনি। ‘সিনাপসে মিডিয়া পেস্নয়ার’ নামক এ মিউজিক
পেস্নয়ারটিতে বিশেষ ধরণের কৃত্রিম ইনটেলিজেন্স ব্যবহার করা হয়েছিল যেটি
ব্যবহারকারীর গানশোনার ‘হ্যাবিট’ বুঝে সে অনুযায়ী নিজস্ব ‘পেস্নলিস্ট’
তৈরি করে গান বাজাতে সড়্গম ছিল। মিউজিক পেস্নয়ারে কৃত্রিম ইনটেলিজেন্স
ব্যবহারের এ ধারণাটি টেক মহারথীদের বিস্মিত করলো ব্যাপক। মিডিয়া পেস্নয়ার
ড়্গেত্রে তাঁদের বিশাল বিশাল ‘টিম গবেষনা’ যে একটি হাইস্কুল বালকের
আবিষ্কারের কাছে রীতিমতো নস্যি! ‘সিনাপসে মিডিয়া পেস্নয়ার’ পিসি
ম্যাগাজিনের জরিপে ৫ এর মধ্যে ৩ র্যাংক পেল। মাইক্রোসফট এবং অ্যাওল উভয়ই
মিডিয়া পেস্নয়ারটি কিনে নিতে চাইলো, এমনকি নিজ প্রতিষ্ঠানে নিযুক্তও করতে
চাইলো ছেলেটিকে। ‘এখনই চাকরি-বাকরিতে নিজেকে জড়াতে চাই না, সংড়্গিপ্ত
করতে চাইনা সৃজনশীলতার পথ। আমাকে আরোও এগিয়ে যেতে হবে। নতুন কিছু তৈরি
করতে হবে।’ ঠাই জবাব ছেলেটির।
প্রিয়
পাঠক, প্রোগ্রামিং পাগল এ ছেলেটির নাম কি এখনও ঠাঁওর করতে পেরেছেন কেউ? যার
গল্প এতড়্গণ ধরে করলাম তিনি হচ্ছেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামাজিক যোগাযোগের
সাইট ফেইসবুক-র প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গ। আর এটি তার ছেলেবেলার
গল্পই বলতে গেলে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, ঘুরে তিনি এতটুকুও সময় নষ্ট
করেননি। কম্পিউটারই ছিল তার একমাত্র খেলার সাথী। আর এ সাথীর সঙ্গে
নির্বিঘ্নেই তিনি খেলেছেন, তাঁর ছেলেবেলার সৃজনশীলতাগুলো দেখাতে পেরেছেন
সবাইকে। কাজের ড়্গেত্রে সমর্থনও পেয়েছেন আশপাশের মানুষগুলোর। সবগুলোই
জুকারবার্গের জন্য বেশ ইতিবাচকই ছিল বলতে গেলে। তবে এর পরের ইতিহাসের
সবগুলো অধ্যায় কিন্তু জুকারবার্গের জন্য সুখকর ছিল না। তবুও তিনি তার
সপ্নের কথা ভুলে যাননি, ভুলেননি ইন্টারনেটে মানুষের যোগাযোগকে সহজ করার
ইচ্ছে।
২০০২
সালের কথা। মাধ্যমিক শেষ করে কেবল হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন
জুকারবার্গ। ততদিনে ‘প্রোগ্রামিং প্রডিজি’ হিসাবে তার সুনাম আশেপাশে বেশ
ছড়িয়েছে। হার্বার্ডে পড়াশোনার পাশাপাশি তার নতুন সপ্ন

ইন্টারনেটে
একটি পারষ্পারিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট তৈরি। যেখানে মূলত সবার ছবি থাকবে আর
বন্ধুরা এসব ছবিতে কিছু মনত্মব্য যুক্ত করবে। হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এ
প্রকল্পটির নাম ছিল ‘ফেইসম্যাশ’। সাইটটি তৈরির পর হার্বার্ডের
শিড়্গার্থীদের ছবি আপলোডের পালা। সব শিড়্গার্থীর ছবি আর জীবনবৃত্তানত্ম
কোথায় পাবেন জুকারবার্গ। সাহসী একটি সিদ্ধানত্ম নিয়ে নিলেন বটে! তিনি
হ্যাক করলেন হার্বাডের শিড়্গার্থী ডাটাবেজ নেটওয়ার্ক। এরপর সেখান থেকে
ছবি সংগ্রহ করে তা ওয়েবে আপলোড করলেন তথ্য সহ। পরদিন থেকেই এটি তুমুল
জনপ্রিয়তা পেল পুরো হার্বার্ড জুড়ে। শিড়্গার্থীরা এটি এতবার ভিজিট করলো
যে পুরো হার্বার্ডের নেটওয়ার্ক সার্ভারই ডাউন হয়ে গেল। প্রথম সফলতা
হিসাবে জুকারবার্গ এতে খুশি হলেও এতে বেশ ঝামেলাও পোহাতে হয়েছিল তাঁকে।
কম্পিউটার নেটওয়ার্ক হ্যাকিংয়ের দায়ে কপালে জুটলো ভর্ৎসনা, অনুমতি
ছাড়াই ছবি আপলোডের কারণে কেউ কেউ ব্যাপক ড়্গিপ্ত হলো জুকারবার্গের উপর।
জুকারবার্গের ওয়েবসাইট বাতিলের জন্য আবেদন জমা পড়ল কয়েক ডজন,
ব্যাক্তিগতভাবেও কেউ কেউ আক্রমণ করে বসলেন তাকে। একটু দমে গেলেন
জুকারবার্গ। কৃতকর্মের জন্য প্রকাশ্যে সবার কাছে ড়্গমা চাইলেন। তবু তার
সপ্ন নিয়ে থেমে থাকলেন না। এগিয়ে যেতে থাকলো ফেইসম্যাশের আদলে নতুন একটি
ওয়েবসাইটের কোডিং, দ্যা ফেইসবুক ডটকম।

২০০৪
সালের ৪ ফেব্রম্নয়ারি চালু হলো জুকারবার্গের তৈরি করা দ্যা ফেইসবুক। চালুর
কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হার্বার্ডের ডরমিটরি রম্নম থেকে দ্যা ফেইসবুক
প্রকল্প গেল পালো আলতোর নিজস্ব অফিসে। প্রায় একই সময়ে হার্বার্ডের
লেখাপড়াও ছাড়লেন জুকারবার্গ। নিজস্ব অফিসে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের
বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিড়্গার্থীদের জন্য চালু হলো দ্যা ফেইসবুক। বড়
আকারে কার্যক্রম শুরম্ন করতে গিয়ে জুকারবার্গ পড়লেন নতুন বিপাকে!
বিনিয়োগকারী দরকার। ধর্না দিতে লাগলেন বিনিয়োগকারীদের দ্বারে দ্বারে।
অনলাইন অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান পেপালের সহ প্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েল
প্রথম বিনিয়োগ করেছিলেন ফেইসবুক প্রকল্পে। তিনি ৫ লাখ ডলারের বিনিময়ে
পেয়েছিলেন ফেইসবুকের ৭ শতাংশ শেয়ার। জুকারবার্গের প্রকল্পের ভবিষ্যত দিন
দিন উজ্জল হতে থাকলো। এরপর একে একে বহু ভেনচার ক্যাপিটালিস্ট ফার্মের
বিনিয়োগ হয়েছে ফেইসবুকে। দূর্দানত্ম গতিতে এগিয়ে যেতে থাকলো ফেইসবুক।
২০০৭ সালের ২৪ মে চালু হলো ‘ফেইসবুক পস্নাটফর্ম’। প্রতিদিনই তৈরি হতে থাকলো
লাখ লাখ নতুন ফেইসবুক ভিত্তিক অ্যাপিস্নকেশন। এরপরের ইতিহাস সবারই জানা।
৬০ কোটি ফেইসবুক ব্যবহারকারী, বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার মুনাফা, ২
সহশ্রাধিক কর্মী আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় বিশাল অফিস।

মাধ্যমিকে
দেখা সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরির কষ্ট সফল হয়েছে জুকারবার্গের। শত
প্রতিবন্ধকতা তিনি এরই মধ্যে পেরিয়েছেন। প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী
হিসাবে ফেইসবুকের ২৪ শতাংশ শেয়ারের মালিকও তিনি। তার বর্তমান ব্যক্তিগত
সম্পত্তি প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। পেয়েছেন বেশকিছু সম্মাননাও
জনপ্রিয়
টাইম ম্যাগাজিন ২০১০ সালের ‘পার্সন অব দ্যা ইয়ার’ ঘোষনা করেছে
জুকারবার্গকে। সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আলতো তে ফেইসবুক অফিসের
পাশেই কিনেছের বিলাসবহুল একটি বাড়ি। এর জন্য জুকারবার্গ খরচ করেছেন ৭
মিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ। ৫ হাজার স্কয়ার ফিটের এ বাড়িতে রয়েছে একটি
‘সল্টওয়াটার পুল’, ৫ টি বেডরম্নম সহ নান্দনিক সব ফিচার। শীঘ্রই এ
‘প্রাসাদে’ উঠবেন জুকারবার্গ। সঙ্গে থাকছে রাজকণ্যা, বিশ্ববিদ্যালয়ে
থাকতেই যার সাথে চলেছে তাঁর প্রেম।
বলতে
গেলে শূণ্য থেকেই শুরম্ন জুকারবার্গের। এরপর একটি সপ্ন কে পুঁজি করে
রাজকণ্যা, প্রাসাদ, ১৪ বিলিয়ন ডলার আর টাইমের মতো ম্যাগাজিনের সম্মাননা!
আর কি চাই? নিজের অবস্থান নিয়ে জুকারবার্গও বেশ উচ্ছসিত। তার সোজা
কথা,সপ্ন দেখেছি বলেই আজকের এই অবস্থান। যখন যেখানে যে অবস্থাতেই ছিলাম না
কেন, নিজের সপ্ন কে পূঁজি করেই যাত্রা ঠিক রেখেছি।’ নতুন প্রজন্মের
উদ্দেশ্যেও জুকারবার্গের সোজা পরামর্শ, ‘ইউনিক এন্ড কুল আইডিয়া’ খুজে বের
করো, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করো, আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলো আর কারো
সমালোচনায় হতাশ হইয়োনা। সাফল্য আসবেই।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন