আমাদের এই মহাবিশ্ব কি একটাই? নাকি অনেক বিশ্বের ভিড়ে আমাদের এ বিশ্ব
নিতান্তই ক্ষুদ্র এক গণ্ডি? সহজ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ৪০০ বছর ধরে
বিরামহীন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষকেরা। ১৬ শতকের জ্যোতির্বিদ জোহান
কেপলার থেকে শুরু করে এ যুগের স্টিফেন হকিং পর্যন্ত মহাবিশ্বের রহস্য
উদ্ধারে বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। তবে কসমোলজি বা বিশ্ব সৃষ্টির
রহস্য উদঘাটনে গবেষকদের সাম্প্রতিক গবেষণার ফল বলছে, এই মহাবিশ্বে কোটি
কোটি বিশ্বের সঙ্গী আমাদের এই বিশ্ব। অর্থাত্ কোটি কোটি বিশ্ব নিয়ে তৈরি
এই অনন্ত বিশ্ব বা মাল্টিভার্স।
আইনস্টাইন বলেছিলেন, বিশ্ব সৃষ্টির সময় স্রষ্টার হাতে আর কোনো বিশ্বের
তুলনা ছিল কি না, এ নিয়ে তাঁর যথেষ্ট কৌতূহল জাগে। অর্থাত্ এই বিশ্ব একটাই
কি না—তাঁর কাছে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল এটা। আইনস্টাইনের জিজ্ঞাসা ছিল
বিস্তীর্ণ ছায়াপথ, অসংখ্য ছায়াপথ ও গ্রহের আবাসস্থল অনন্য বিশ্ব সৃষ্টির
ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম কি বাঁধাধরা? নাকি আমাদের এই বিশ্ব ছাড়াও
অন্য কোথাও একই নিয়মে তৈরি হয়েছে আরও বিশ্ব?
আইনস্টাইনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বর্তমান সময়ের গবেষকদের মনে জন্ম
নিয়েছে নতুন প্রশ্নের। প্রতি বছর গাড়ির ক্ষেত্রে যেমন নতুন নতুন মডেল
নতুন সুবিধা নিয়ে বাজারে আসে, সেই গাড়ির বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন মানুষের
জন্য ব্যবহার উপযোগী করা হয়, তেমনি এই বিশ্বের ক্ষেত্রেও কি
নিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তন ঘটে? গবেষকদের ভাষ্য, শক্তিশালী টেলিস্কোপ ও লার্জ
হ্যাড্রন কোলাইডারের মতো কণা বিশ্লেষণ করার যন্ত্রের মাধ্যমে আমরা এ
প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাব।
বিশ্বের সৃষ্টিরহস্য নিয়ে আইনস্টাইনের পর থেকে আরও গভীর পর্যালোচনা ও
গবেষণা করেছেন গবেষকেরা। আইনস্টাইন কেবল পদার্থবিদ্যার সূত্রের মধ্যেই
বাঁধতে চেয়েছিলেন এই বিশ্বরহস্যকে। কিন্তু এখন কেবল আর অনুমান বা
তত্ত্বনির্ভর নয়, পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ হাজির করতে কাজ করছেন গবেষকেরা।
প্রথম দিকের গবেষকেরা কেবল আমাদের বিশ্বের মধ্যে কী রয়েছে, সে গবেষণা
করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে গবেষকেদের লক্ষ্য, আমাদের এই বিশ্বের বাইরে
অন্যান্য বিশ্বের সন্ধান করা। মাল্টিভার্স বা অনন্ত বিশ্বের ধারণাকে
প্রতিষ্ঠিত করেছে বিগ ব্যাং তত্ত্ব, ইনফ্ল্যাশনারি কসমোলজি বা স্ফীতিতত্ত্ব
ও স্ট্রিং থিওরি। এই তিনটি তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন—এমন গবেষকদের ভাষ্য,
আমরা অনন্য বিশ্বে নয়, আমরা অনন্ত ও কোলাহলপূর্ণ বিশ্বে বাস করছি। আমাদের
বিশ্বের বাইরে যেসব বিশ্ব রয়েছে, সেই বিশ্ব আমাদের বিশ্বের চেয়ে সম্পূর্ণ
আলাদা হতে পারে। এ বিশ্বগুলো তৈরি হতে পারে অন্য কোনো কণায়। সেখানে
রাজত্ব করতে পারে অন্য কোনো শক্তি। এ অনন্ত মহাবিশ্বে হয়তো কোলাহলপূর্ণ
মহাজাগতিক আলাদা আলাদা বিষয় ছড়িয়ে রয়েছে।
অনন্ত মহাবিশ্ব বা একাধিক বিশ্বের এই তত্ত্ব নিয়ে সব গবেষকেরা একমত নন।
অনেকে এই ধারণাকে এখনো অনুমাননির্ভর ও বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাতীত ও
বাস্তবতা-বিবর্জিত বিষয় বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা কোন পক্ষে যাব, কী
বিশ্বাস করব? অনন্ত মহাবিশ্ব, নাকি একক মহাবিশ্ব? এ সংশয়ের বাধা ও সন্দেহ
দূর করতে আমাদের বিগ ব্যাং তত্ত্বের মধ্যে ঢুঁ মারতে হবে।
১৯১৫ সালে ‘জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি’ বা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ
করেন আইনস্টাইন। মাধ্যাকর্ষণ বল নিয়ে ১০ বছরের গবেষণা শেষে আইনস্টাইন
আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ করেন। বিজ্ঞানের অসাধারণ গাণিতিক এক সমীকরণ
প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মহাবিশ্ব সৃষ্টি ও পরিণতির একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেল।
আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি কাজে লাগিয়ে ‘স্পেস-টাইম’ বা
স্থান-কালের ধারণার যে বিবর্তন ঘটে গেল—তার হাত ধরেই মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও
ভবিষ্যত্ পরিণতির একটা যৌক্তিক ধারণা পাওয়া গেল।
এর পর গবেষকেরা জানালেন, প্রতিনিয়ত সম্প্রসারণ ঘটছে এই মহাবিশ্বের।
অর্থাত্ প্রতিটি গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ পরস্পর থেকে প্রতিনিয়ত দূরে সরে
যাচ্ছে। মার্কিন জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল ১৯২৯ সালে তা নিশ্চিত করেন।
গবেষকেরা ভাবা শুরু করলেন, মহাবিশ্ব যদি সম্প্রসারিত হতে থাকে, এই
সম্প্রসারণ শুরুর আগে নিশ্চয় মহাবিশ্বের উপাদানগুলো একসঙ্গে প্রচণ্ড ঘনত্ব
নিয়ে ক্ষুদ্র অবস্থায় ছিল। সুদূর কোনো অতীতে এই ক্ষুদ্র বস্তুটিই
বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমাগত প্রসারিত হতে থাকে। গবেষকেরা এই
ঘটনাটিরই নাম দিলেন ‘বিগ ব্যাং’। এ তত্ত্বটি অনেকের সমর্থনও পেল। তবে তাঁরা
বিগ ব্যাং তত্ত্বের মধ্যেও দুর্বলতা খুঁজে পেলেন। তাঁদের প্রশ্ন, বিগ
ব্যাংয়ের ফলে সবকিছুই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়লে এই অঘটনের পেছনে কোন শক্তি আর
কেনই বা ঘটল বিগ ব্যাং? এই শক্তির প্রমাণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা গবেষকেরা
দাঁড় করাতে পারেননি।
গত শতকের আশির দশকে পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালেন গোথ বিগ ব্যাং থিওরির বর্ধিত
সংস্করণ উপস্থাপন করলেন; যাকে বলা হয় ইনফ্ল্যাশনারি কসমোলজি বা
স্ফীতিতত্ত্ব। তাঁর তত্ত্বে উঠে এল মহাজাগতিক এক জ্বালানির তথ্য, যা এই বিগ
ব্যাং ঘটাতে পারে। আর এই জ্বালানির ফলে মহাজাগতিক বিস্ফোরণে বেলুনের মতো
স্ফীত হতে শুরু করে মহাবিশ্ব। বিগ ব্যাং তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আশির
দশকে ইনফ্ল্যাশন বা স্ফীতিতত্ত্ব নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের প্রান্তিক
গণিতগুলো সমাধান করতে গিয়েই এই অদ্ভুত ব্যাপারটি ক্রমেই বেরিয়ে আসছিল। এ
সময়কার গবেষক আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিন এবং আদ্রে লিন্ডে খুব অবাক হয়ে
লক্ষ্য করলেন মহাজাগতিক স্ফীতি একবার শুরু হলে আর থামে না। এ ব্যাপারটিকেই
বিজ্ঞানীরা বর্তমানে ‘চিরন্তন স্ফীতি’ নাম দিয়েছেন। অনন্ত মহাবিশ্বের
ধারণা মূলত এই চিরন্তন স্ফীতিতত্ত্বেরই স্বাভাবিক একটি গাণিতিক পরিণতি।
আমাদের মহাবিশ্ব যদি কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে স্থান-কালের
শূন্যতার ভেতর দিয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকে, তবে এই পুরো প্রক্রিয়াটি কিন্তু
একাধিকবার ঘটতে পারে। সৃষ্টির উষালগ্নে স্ফীতির মাধ্যমে সম্প্রসারিত বুদবুদ
থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মতোই অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে, যেগুলো একটা
অপরটা থেকে পৃথক।
মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের আবিষ্কার বৈপ্লবিক হলেও সম্প্রসারণের একটি বিষয়ে সব
গবেষকেরা একমত। পৃথিবীর মহাকর্ষ বল যেমন কোনো বলকে ওপরের দিকে যেতে বাধা
দেয়, তেমনি প্রতিটি গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের মধ্যে বিদ্যমান আকর্ষণ বলও
মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। ১৯৯০ সালে
জ্যোতির্বিদদের দুটি দল সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এ ধীরগতির তথ্য বের করেন।
বিভিন্ন ছায়াপথ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে গবেষকেরা মহাবিশ্ব
সম্প্রসারণের একটি নির্দিষ্ট গতি বের করেন। এই বিশ্লেষণ শেষ হলে তাঁরা লক্ষ
করলেন ৭০০ কোটি বছর আগে থেকে এই মহাবিশ্বের মধ্যে সম্প্রসারণের গতি বেড়ে
গেছে। অর্থাত্ মহাবিশ্ব এখন কেবল সম্প্রসারিত হচ্ছে। শূন্যে কোনো বল যদি
নিক্ষেপ করা হয়, প্রথমে যেমন এর গতি কম থাকে, এরপর হঠাত্ করেই যদি রকেটের
গতি পায়—এমন অবস্থা এ মহাবিশ্বের। এখানে প্রশ্ন উঠছে, মহাবিশ্বকে কোন
শক্তি এভাবে একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং মহাজাগতিক
সম্প্রসারণের গতি আরও দ্রুততর করছে? এই প্রশ্নটির উত্তর পেতে আবারও ফিরতে
হচ্ছে আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির কাছেই। একটি অদৃশ্য শক্তি,
যাকে আমরা ‘ডার্ক এনার্জি’ বলছি, এটাই বিশ্বের সম্প্রসারণের কারণ।
গবেষকেরা বর্তমান সময়ে ডার্ক এনার্জি নিয়ে বিস্তর গবেষণা করছেন। তবে এখনো
গবেষণার উপসংহারে পৌঁছে ডার্ক এনার্জির বিস্তারিত জানাতে পারেননি তাঁরা।
অনন্ত এই মহাবিশ্বের ধারণা ষোড়শ শতকের পুরোনো। বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ জোহান
কেপলার পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যকার দূরত্ব নিয়ে যে গবেষণা শুরু করেছিলেন। ৯৩
মিলিয়ন মাইলের নির্দিষ্ট এই দূরত্বের মধ্যে কী রহস্য রয়েছে, এই গবেষণা
নিয়ে কেপলার গলদঘর্ম হলেও আমরা এখন জানি, এই দূরত্বের মধ্যে কী রয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, প্রাণের ধারণের উপযোগী পরিবেশ হিসেবে এই দূরত্ব প্রয়োজন।
এখানেই নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও শক্তির উত্স রয়েছে, যা প্রাণ ধারণের জন্য
উপযুক্ত। এই দূরত্বতত্ত্বটিই গবেষকদের কাছে ডার্ক এনার্জিকে গুরুত্বপূর্ণ
করে তুলেছে। আমাদের সেরা মহাজাগতিক তত্ত্বটির নাম স্ফীতিতত্ত্ব অন্যান্য
বিশ্বের ক্ষেত্রে দূরত্বের কথা বলে। যেখানে বিভিন্ন দূরত্বে বিভিন্ন গ্রহ
তাদের নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এখানে এ রকম অনেক বিশ্ব রয়েছে এবং
বিভিন্ন পরিমাণ ডার্ক এনার্জিও রয়েছে। পদার্থবিদ্যায় ডার্ক এনার্জির
নির্দিষ্ট গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে বলা আর নির্দিষ্ট গ্রহের মধ্যকার দূরত্বের
কারণ ব্যাখ্যা করতে বলার মতোই ভুল পথে যাওয়া। তার চেয়ে সঠিক প্রশ্নটি
হতে পারে, আরও অনেক সম্ভাব্য কারণ থাকতেও মানুষ কেন নির্দিষ্ট পরিমাণ ডার্ক
এনার্জি-বিশিষ্ট বিশ্বে নিজেদের আবিষ্কার করল?
গবেষকদের কাছে এই প্রশ্নটির উত্তর তৈরি রয়েছে। তাঁরা বলেন, বিশাল ডার্ক
এনার্জিযুক্ত বিশ্বে মহাজাগতিক বস্তু যখন গুচ্ছ আকারে গ্যালাক্সি বা
ছায়াপথ তৈরির জন্য একজোট হয়, তখন ডার্ক এনার্জির প্রবল শক্তি এগুলো ছিটকে
ফেলে এবং গ্যালাক্সি তৈরিতে বাধা দেয়। যে বিশ্বের ডার্ক এনার্জি যতটা কম,
সেখানে বস্তুগুলোকে ধাক্কা দেওয়ার বা ছিটকে ফেলার পরিবর্তে আকর্ষণ করে ও
গঠনে বাধা দেয়। তাই বিশ্ব গঠনে সঠিক পরিমাণ ডার্ক এনার্জির অস্তিত্বের
প্রয়োজন পড়ে।
তবে মানুষ এমন একটি বিশ্বে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে, যেখানে প্রাণ ধারণের
উপযোগী পরিবেশ গড়ে উঠেছে। ডার্ক এনার্জি রহস্যের সমাধান করতে মাল্টিভার্স
বা অনন্ত এই মহাবিশ্বের প্রশ্নের একটা সমাধান হতে পারে। ডার্ক এনার্জি
তত্ত্বের সফলতা আবার নির্ভর করছে মাল্টিভার্সের মধ্যে বিভিন্ন পরিমাণে
ডার্ক এনার্জি থাকার বিষয়টির ওপর। আর এ কারণেই গবেষণার তৃতীয় প্রান্তিকে
এসে দেখা মেলে স্ট্রিং তত্ত্বের। বর্তমানকালের পদার্থবিজ্ঞান দুটো মৌলিক
স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। একটি হলো আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা এবং অন্যটি হলো
কণাবাদী বলবিদ্যা। আপেক্ষিকতা একটা অসাধারণ সূত্র। এটি দিয়ে গ্রহ,
নক্ষত্র, নীহারিকা, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতা, স্থান-কালের মতো
ব্যাপারগুলো চমত্কার ব্যাখ্যা করা যায়। একইভাবে আণুবীক্ষণিক কণাগুলোর
ক্ষেত্রে কণাবাদী বলবিদ্যা খুব কার্যকর। তারা উভয়ই সঠিক বলে প্রমাণিত।
স্ট্রিং তত্ত্ব হচ্ছে, আইনস্টাইনের ইউনিফায়েড থিওরি বা একীভূত করার
তত্ত্ব, যেখানে তিনি সব বস্তু ও বলকে একটি গাণিতিক সূত্রের মাধ্যমে এক করার
চেষ্টা করেছেন। পদার্থের গঠনকাঠামো ব্যাখ্যা করার কষ্টসাধ্য এই বিষয়টিকে
চমত্কার ও সরলভাবে উপস্থাপন করা যায় স্ট্রিং তত্ত্ব দ্বারা। অতিপারমাণবিক
কণা দিয়ে সব ধরনের পদার্থ, সর্বোপরি মহাবিশ্বের সৃষ্টিকে আসলে তুলনা করা
যায় বেহালার তার বা ড্রামের মেমব্রেনের মাধ্যমে সুর সৃষ্টির সঙ্গে।
পদার্থবিজ্ঞানীরা ইলেকট্রনকে গণ্য করেন অতিক্ষুদ্র একটি মৌলিক কণা হিসেবে।
স্ট্রিং তত্ত্ব মতে, ইলেকট্রনের ভেতরটা যদি অত্যাধুনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র
দিয়ে দেখা সম্ভব হতো, তাহলে আমরা কোনো কণা দেখতাম না, আমরা দেখতাম কম্পিত
এক তার। অর্থাত্ বর্তমানে পাওয়া মৌলিক কণাগুলো আসলে মৌলিক নয়, এরাও
বিভাজ্য। এটাকে আমাদের কণা বলে মনে হয়, কারণ আমাদের যন্ত্রগুলো এত সূক্ষ্ম
পরিমাপ উপযোগী নয়। এই অতিক্ষুদ্র তারগুলোই আসলে ভিন্ন ভিন্ন কম্পাঙ্কে
স্পন্দিত ও অনুরণিত হয়। আমরা যদি একটি অতিপারমাণবিক কণার সূক্ষ্ম তারের
কম্পনের হার পরিবর্তন করে দিই, তাহলে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আরেকটি
অতিপারমাণবিক কণা সৃষ্টি হবে। ধরা যাক কোয়ার্ক। এখন সেটি যদি আবার
পরিবর্তন করি, তাহলে হয়তো পাওয়া যাবে নিউট্রিনো। সংগীতে আমরা যেমন
ভায়োলিন বা গিটারের তার কাঁপিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নোট সৃষ্টি করি,
অতিপারমাণবিক কণাগুলোও সে রকম ভিন্ন ভিন্ন নোট। সুতরাং অসংখ্য অতিপারমাণবিক
কণাকে শুধু একটি বস্তু দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব, সেটা হলো স্ট্রিং বা
তার!
স্ট্রিং তত্ত্ব ডাইমেনশনের বা মাত্রার ধারণাও পরিবর্তন আনে। এতে আপেক্ষিকতা
আর কণার বলবিদ্যার একটা পুরোনো বিরোধ মীমাংসার দিকে এগিয়ে যায়। গবেষকেরা
ধারণা করছিলেন, স্ট্রিং তত্ত্ব গাণিতিক কাঠামো হয়তো সবকিছু একই সংজ্ঞার
আওতায় আনতে পারবে। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও এই তত্ত্বের গাণিতিক সূত্র
নিয়ে নানা বিশ্লেষণ করে নানা ফল পেলেন গবেষকেরা। সবাই আলাদাসংখ্যক
মহাবিশ্বের সন্ধান পেলেন। আর এই মহাবিশ্বের সংখ্যা এতটাই বেশি হতে পারে যে
১০-এর পর ৫০০ টিরও বেশি শূন্য হলে যে সংখ্যা দাঁড়ায়, তার সমান। স্ট্রিং
তত্ত্বের মাধ্যমে অনন্য বা একক মহাবিশ্ব খুঁজতে ব্যর্থ হয়ে তাঁরা
মাল্টিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের গুরুত্ব নিয়ে ভাবতে বসেন। মাল্টিভার্সের
এই বিষয়টি অনেকটাই জুতার দোকানের মতো, যেখানে সব ধরনের পায়ের মাপের জুতা
পাওয়া যায়। আর এ অনন্ত মহাবিশ্বে আমাদের বিশ্ব নির্দিষ্ট পরিমাণ ডার্ক
এনার্জির অস্তিত্বের জন্য উপযুক্ত স্থানে রয়েছে। এখানে অবশ্য
স্ফীতিতত্ত্বের সঙ্গে বিরোধ ঘটে যায়। স্ফীতিতত্ত্বে বলা হয়, বিগ
ব্যাংয়ের ফলে অসংখ্য বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে একই রকম বৈশিষ্ট্যযুক্ত
বিশ্ব রয়েছে। অর্থাত্ জুতার দোকানে কেবল একই আকারের জুতাই পাওয়া যাবে। যে
মাপের জুতা খোঁজ করা হবে, সে ধরনের জুতার অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে।
এর পর গবেষকেরা স্ফীতিতত্ত্ব ও স্ট্রিং তত্ত্ব একসঙ্গে করে সমাধানে চেষ্টা
চালিয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন, অনন্ত এই মহাবিশ্বের সংখ্যা অসংখ্য।
স্ফীতিতত্ত্ব ও স্ট্রিং তত্ত্বের সমন্বয়ে অসংখ্য মহাবিশ্বের মধ্যে একটি পর
একটি বিগ ব্যাংয়ের ফলে আমাদের মতো বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। আর বিশেষ বিশ্ব
তৈরিতে যে বৈশিষ্ট্য লাগে বা প্রাণ ধারণের উপযোগী পরিবেশযুক্ত বৈশিষ্ট্যের
ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বের সৃষ্টি তারই একটি ঘটনামাত্র।
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো দাবির জন্য পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ হাজির করতে
হয়। মাল্টিভার্সের ক্ষেত্রে সেই যথেষ্ট প্রমাণ কি জোগাড় করা গেছে? আমাদের
বিশ্বেরই যখন অনেক কিছু এখনো পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি, সেখানে অন্যান্য
বিশ্ব পর্যবেক্ষণের বিষয়ে ইতিবাচক কোনো উত্তর নেই। তাহলে অনন্ত এই
মহাবিশ্বের দাবি কি কেবল অনুমাননির্ভর, যা বিজ্ঞানের আওতায় পড়ে না?
গবেষকেরা এখনই অবশ্য হাল ছাড়ছেন না বা ব্যাখ্যাতীত বলে উড়িয়েও দিচ্ছেন
না। গবেষকেরা টেনে আনছেন ব্ল্যাকহোলের (কৃষ্ণবিবর) উদাহরণ। আইনস্টাইনের
সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ব্যবহার করে ব্ল্যাকহোলের মধ্যে কী ঘটছে, সে
ব্যাখ্যা যদি বিজ্ঞানের মধ্যে পড়ে, তবে মাল্টিভার্সও কেন নয়? কৃষ্ণবিবর
বা ব্ল্যাকহোল বিষয়ে তো কেউ পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা লব্ধ প্রমাণ হাজির
করেননি।
এখন পর্যন্ত ব্ল্যাকহোলের কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কারণ এ
থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতে পারে না কিন্তু এর উপস্থিতির প্রমাণ আমরা
পরোক্ষভাবে পাই। ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্বের প্রমাণ কোনো স্থানের নক্ষত্রের
গতি এবং দিক দেখে পাওয়া যায়। এই তত্ত্বটিরও কোনো পর্যবেক্ষণ করা হয়নি।
অর্থাত্ কেবল অনুমাননির্ভর। এভাবে মাল্টিভার্স নিয়ে যদি অনুমান ও
আত্মবিশ্বাস থাকে, তবে এ তত্ত্বও সত্য হতে পারে।
অনুমাননির্ভর হলেও এখন পর্যন্ত ডার্ক এনার্জির বিস্তার ও মাইক্রোওয়েভ
রেডিয়েশনের তারতম্য নিয়ে স্ফীতিতত্ত্বের ব্যাখা সঠিক মনে করেন গবেষকেরা।
শক্তিশালী দুরবিন ও কণা নিয়ে পরীক্ষা করার যন্ত্রেও স্ট্রিং তত্ত্ব
পর্যবেক্ষণের সুযোগ ও প্রযুক্তি না থাকায় এখনো তত্ত্বেই রয়ে গেছে। এ দুটি
তত্ত্বের পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ না থাকলেও গবেষকেরা বলছেন, মাল্টিভার্সের
আরেকটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ হতে পারে আমাদের মহাবিশ্বের সঙ্গে প্রতিবেশী
মহাবিশ্বের সংঘর্ষ। এই দুইয়ের সংঘর্ষে যে তাপ উত্পন্ন হয়, সে তাপের
তারতম্য এখন বোঝা না গেলেও ভবিষ্যতে হয়তো শক্তিশালী টেলিস্কোপে তা শনাক্ত
করা যাবে। অনেক গবেষকই মাল্টিভার্স খোঁজ পাওয়ার ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনাকে
সমর্থন দিয়েছেন।
নিউটন যখন আপেল গাছের নিচে বসে ছিলেন, তখন তিনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্র
আবিষ্কার করতে বসেননি। মাথায় আপেল পড়ার পর তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, আপেল
নিচে পড়ল কেন? উপরেও তো যেতে পারত? নিউটন আপেল নিচের দিকে পড়ার বিষয়টি
নিয়ে গবেষণা করেন এবং মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তারতম্য সহজেই সবার বোধগম্য হলো।
কিন্তু আপেলগুলো আরও আগেই মহাশূন্যে রওনা হয়ে গেছে কি না, সে রহস্যের
কিনারা হয়নি। এই রহস্য উদ্ধারে আরও নিবিড়ভাবে ভাবছেন গবেষকেরা। বিষয়টি
নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক গবেষণা চলবে। কারণ আমাদের প্রতিবেশী কোনো
বিশ্বের অস্তিত্ব থাকার বিষয়টি আরও কৌতূহল জাগিয়ে রাখবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন